Header Ads

কবি বেলাল চৌধুরীর ১০টি কবিতা


কবি বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালে ১২ নভেম্বর, ফেনীতে। ছাত্র অবস্থায় তিনি বাম ধারার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন; ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাগারেও যান।

কৃত্তিবাস সম্পাদনায় যুক্ত হন কবি।

বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সে সময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক বেলাল চৌধুরী ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। রূপালী গ্রুপের ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ’ পত্রিকাটিও তিনি সম্পাদনা করেন।ষাট ও সত্তরের দশকে বেশ কয়েক বছর ভারতের কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’-এ চাকরি করেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থিরজীবন ও নিসর্গ’, ‘স্বপ্নবন্দী’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে’ ও ‘বত্রিশ নম্বর’।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে একুশে পদক পান কবি বেলাল চৌধুরী; পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।

২৪ এপ্রিল ২০১৮ মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।



তুমি সেই বৃক্ষ

জটিল অরণ্যে তুমিই একমাত্র বিটপী
শালের মত অটল, সেগুনের মত নমনীয় ও কোমল
ঝাউয়ের মত তোমার মর্মরিত মাধুর্যের দিকে, কাঠুরেও
তার কুড়ালের হাতলে আলতো হাত রেখে দাঁড়ায় ফিরে |

বৃষ্টি তবু তুমি, তোমার উড়ন্ত উজ্জ্বল সবুজ চুল
দূরের বাতিঘরের মতই করে প্রলোভিত ;
অরণ্যের বিষণ্ণতার ভেতর হঠাৎ বিচ্ছুরিত
বসন্তের মঞ্জুরিত রাজফুলের মত তোমার রক্তিম অধর |

তুমি সেই বোধিদ্রুম যার প্রতি,
দিবাবসানে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ভবঘুরেও দাঁড়ায় ফিরে
দিক নির্দেশের জন্য, তুমি সেই লক্ষভেদী
অনুকূল আগুনের প্রতি প্রলুব্ধ করে
জ্বেলে দাও লেলিহান শিখা
আলোকিত করে তোল সমগ্র পশ্চাৎপট |

তুমি সেই বৃক্ষ, আমি কুঠার হয়ে দেখেছি :
তোমার সমারোহের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে
চিহ্নিত করি তোমাকে নিজেরই জন্য,
সহিষ্ণু , ধূর্ত  ও কুশলী হাতে
তোমার দেহকে অনাবৃত করে
নিয়ে যাই তোমার হৃদয় নিজেরই গূঢ় প্রয়োজনে |



প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি

আমার গোপন পাপগুলি এতদিন পর
বিরূপ-বৈরিতায় শস্ত্রপাণি হয়ে উঠেছে

এবার তাদের বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠে
উচ্চারিত হলো- আমার কঠোর দণ্ডাজ্ঞা
আমার মাথার ওপর উত্তোলিত তীক্ষ্ন কৃপাণ
চোখের সামনে জ্বলন্ত লাল লৌহশলাকা
ওদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এবার ওরা অটল
আমার সর্বাঙ্গ ছেঁকে ধরেছে মাছির মতো
বিস্ফোটক দগদগে ঘা পুঁজ আর শটিত গরল
গোপন পাপের শরশয্যায় শুয়ে আমি
নিদারুণ তৃষ্ণায় ছটফট করছি- হায় রে জলধারা
কিন্তু এবার ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- নিষ্কৃতি নেই আমার
নির্বাসনে মৃত্যুদণ্ড- ঠাণ্ডা চোখে দেখছি আমি
নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে আমার দেহ।


খর্বকায় বামনের গান

ওরে ও, বুড়ো হাবড়া, নিতান্ত সঙিনাবস্থায়
প্রসারিত পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে,
চেনা জগৎ সীমার ওপর ঝুঁকে গ্রন্থিল
প্যাচানো কোনাচে- যে রকম কেউ কেউ-
মনে আঁকে ছবি বা মাপে বয়স;-
খাটো বহর ওদো, অতীতচারি ওরা হাওড়ায়
নিজেদের শিকর সম্পর্কে জ্ঞাত অজ্ঞাত
বহু বহু বরকনদাজি গুল গল্প
যাকে এক কথায় বলা যায় বার ফট্টাই...


স্বদেশ

আমি আছি ব্যাপ্ত হয়ে তোমার রৌদ্রছায়ায়
এই তো তোমার ঘামে গন্ধে তোমার পাশাপাশি
তোমার ছায়ার মতো তোমার শরীর জুড়ে
তোমার নদীর কুলকুল স্রোতে ;
তোমার যেমন ইচ্ছে, আছি আমি----
ঝিরিঝিরি পাতার ভেতর ভেতর হাওয়ার নাচে
রাত্রিদিন তোমার ধানের ক্ষেতে
উদাসী বাউল ; ভাটিয়ালি গান ভেসে
যায় কোন নিরুদ্দেশে ; আছি আমি
বেলা শেষের রোদের মতো
গড়িয়ে তোমার পায়ে পায়ে
আছি আমি তোমার ধানের দুধে
তোমার আঁচল ছোঁয়া নীলাম্বরী মেঘে
আছি আমি এই তো তোমার
নাকছাবিটির মুক্তো যেমন
জ্বলছে কেবল জ্বলছে কেবল |



আত্মপ্রতিকৃতি

সারাদিন আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে
কী দেখেছিলাম ? ভাট ফুল, আকন্দের ঝোপঝাপ
মাছরাঙাদের অকারণ খিটিমিটি ?
গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তীখ্যাত
মসলিন, নকশিকাঁথার দিন !

গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর বরা মাছ
এ জাতীয় কথারা আজ সেরেফ কথার কথামালা
গ্রামগুলি হতশ্রী, এমনকি অগুনতি, অনেক মানুষ
মিলিয়ে যে-মানুষের ছবি চোখের সামনে জেগে ওঠে
তার মত হতকুচ্ছিত প্রাণী যেন আর কিছুই হয় না----
লিকলিকে সরু পা, রোগা কাঠাম আর ডিগডিগে পেট,
চোখেমুখে ঘোলাটে নির্বোধ শূন্যতা ---- তবু ঐ সব মানুষের ভিড়ে
একজন মানুষের খোঁজে পথ হাঁটছিলুম আমি আপন মনে
তখন না-বিকেল না সন্ধ্যা এমন একটা আলগা সময়
পাখিরা কুলায়ের পথে কূজন মুখর
ঠিক আমার বা পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি শীর্ণতোয়া
 রোগা দুঃখী নদী,
কুলুকুলু শব্দ বা গরুর খুরে ধুলো ওড়া কাব্যিক গোধূলি
কিন্তু তার ধারে কাছে কোথাও পড়ল না চোখে,
বরং দেখলুম বাঁশের খুটিতে আড়াআড়ি টানা
দড়ির ওপর শুকোতে দেয়া ঝুলন্ত জালের গায়ে
লেগে থাকা মৃত কিছু মাছের সাদা পেট, আঁশ;----
তার অন্য পাশে ছিল পথের লাগোয়া একটি প্রাচীন মসজিদ
আগাছা শ্যাওলা ও খরখরে গুল্মের জরাজীর্ণ
দেওয়ালের গা ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসা অশ্বথ্বের একটি ডাগর চারা
নদী থেকে ভেসে আসা ঝিরঝিরে হাওয়ার লাবণ্যে
মুখ বাড়িয়ে যেন দেখছিল নদীটিকে
এই  দুই ভিন্ন প্রেক্ষিতের মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে
হঠাৎ আমার মনে হল : এই বিংশ শতাব্দীর একজন নিঃস্ব
নিঃসঙ্গ মানুষ আমি 
ভান করি স্বেচ্ছা নির্বাসিতের, অনিকেত  বলতে উদ্বাহু হয়ে উঠি
অথচ জন্মেছি এই সব অখ্যাত গ্রামে গঞ্জেই         
পূর্বপুরুষেরা ছিলেক কৃষিকর্মী ;
অধুনা আত্মপ্রতারণায় নগরনিবাসী আমি
আর কতকাল এমন করে নিজেকেই নিজের চোখ ঠাওরাবো |



ডুবে আছি কেতকী কুসুমে

ডুবে আছি কেতকী কুসুমে চেয়ে দ্যাখো কি রকম উতরোল
হাওয়া আর ঢেউয়ে ফেনিল, রুপালি রণরোল
নিঃশেষে মুছে দিয়ে নীল নীলিমা সাধ
সৌর চলচ্ছবি যেন অবাধ, অগাধ ;

জ্যোতির্ময় বলয় জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছি
কৃতদার পাতার হলুগ ; পাতা ঝরে যায়-
পাতা ঝরে যায় বৃন্ত থেকে, মৃত মাছি
যেন টুপটাপ ; অচ্ছোদসরসী নীরে ভাসে ভেলা,
হায় যুগল সহায়।
ডুবে আছি কেতকী কুসুমে
বিস্মরণে ব্যাপ্ত নিদারুণ জাগরণ ও ঘুমে।

নারীটি যখন নদী হয়ে গেল

সে কি তার মৃত্যু দৃশ্যে
পেয়েছিল পরিপূর্ণতা, কে জানে!
না হলে ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসিটি
কি করে ফুটিয়ে তুলেছিল ঐ বিভ্রম ; ---

নগ্ন পদযুগল যেন নীরবে কওয়াকয়ি করছিল
এসেছি ঢের দূর, আর নয়,
নদীটি বহে যাচ্ছিল আপন মনে
এঁকে বেঁকে হেলায় ফেলায় . . .
ভরা জোয়ারের টানে গেল ভেসে
জ্যোত্স্না উদ্ভাসিত চরাচরকে আঁধারে ডুবিয়ে।

কুলাঙ্গার

ত্বকীকে নিয়ে কবিতা

ছিঃ!
হিমেল জ্যোৎস্নায় ভেজা রক্তখোর চিল
সূর্যোদয়ের আগে যে সদ্যপ্রস্ফুট গোলাপে বসালে
তোমার নোংরা হিংস্র নখের আঁচড়ে
তা আমার পবিত্র পতাকাকেই কলঙ্কিত করলো।

থুঃ!
তোমার কৃত্রিম দেশপ্রেমে, ধিক তোমার বারুদবিলাসী
মেকি গণতন্ত্রের উল্লাসে। সবই তোমার কুরাজনীতির
গণিতশাস্ত্র। তুমি নগরবাসীর লজ্জা,
ত্বকীর আত্মার অভিসম্পাতে অভিশপ্ত তুমি।

মনে রেখো, পুড়ে খাক হবে তোমাদের ময়ুরপুচ্ছ সকল ডানা,
কেননা জ্বলবে, জ্বলে উঠবেই প্রখর প্রতিভার দীপ্ত অঙ্গার।
খুনি তুমি, পাপী তুমি, মুক্তিযুদ্ধের সবুজ-চেতনার কুলাঙ্গার।

সেই সুখ

প্রতি মুহূর্তে বদলায় জীবন
পৃথিবী অনুভব করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা
পাখিরাও এ ডালে ও ডালে ঘুরে ঘুরে দেখে
কখনও আটকে যায় মাঝ মাঠে
শিকারি সঠিকভাবে চলতে বাধা পায়
বদলে যায় তার স্নায়ু হাতের আঙ্গুল
নিশানা মস্তিষ্কের হোঁচটও খায় কখনও।

কিন্তু কি আশ্চর্য একমুহূর্ত এলো এখানে
আমার জীবনে যা লিখা হয়ে গেল নিদ্বর্িধায়
হৃদয়ের খাতায় রচিত হলো কাব্যগ্রন্থ অন্তরে
শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অনুভূত হল স্পন্দন।

জানতে চাও সেটি কি এমন অভিনব
অনুভব! শুনে রাখ সুদর্শন সুদীর্ঘ অপেক্ষার সাম্পানে
চড়ে বিশ বছর পর তোমাকে যা দেখছি মনে হচ্ছে সেই সুখ
তুমি একটুও বদলাওনি পুরোপুরি আলোর মতন।
যেন আগেরই সেই সুখ।


মানুষের ডাহুকী ভাবনা

মানুষতো ডাহুক নয় অথচ ডাহুকের বেদনার
ভেতরে মানুষ ডুবে যেতে পারে, ডুব দেয়
চিরকাল- এইভাবে মানুষের ডাহুকী ভাবনা
মূত্ররসে যেমন ভেসে যায় মানুষের
স্বভাবের নির্বিবেকী তাবৎ লোনা ও অম্লতা
তেমনি মানুষ ঢেলে দিতে পারে
ঐ ডাহুকী ভাবনার ভেতর মানুষের
যতো বেদনা, বিষতিক্ত সারাৎসার,
ডাহুক ও মানুষ যদিও পরস্পর বেদনার
এপিঠ-ওপিঠ, কিছুটা মানুষের, কিছুটা ডাহুকের
তবু মানুষ তো কখনো ডাহুক নয়
অথচ ডাহুক তার বেদনার সীমা- স্বর্গের কতোদূর,
কতোদূর- একজন মানুষকে নিয়ে যেতে পারে?


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.