Header Ads

শিল্পর শিল্পী মেয়র আনিসুল হক - আমির সোহেল


একটি মানুষ সর্বজন, সর্ব মতের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। পাওয়াটা বড়ই কঠিন ব্যাপার। এক কথায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। সেই কঠিন কাজ সহজ করেছিলেন এই সময়ের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি। তার নাম শুনলে, মানুষ ভালোলাগা নিয়ে নড়েচড়ে বসে। এই মহৎ হৃদয়ের উজ্জীবিত মানুষ অসময়ে হারিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের মানুষ একজন কর্মঠ জনপ্রতিনিধি হারালেন। যার কথা বলছি তিনি মেয়র আনিসুল হক।

মেয়র আনিসুল হক নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। এছাড়া তার শৈশবের বেশকিছু সময় কাটে তার নানা বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তার বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। তারা চার ভাইবোন ছিলেন। মা-বাবা ও চার ভাইবোন মিলে তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৬ জন। তার ছোটভাই পড়তো ক্যাডেট কলেজে (যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান)। পরিবার ও ছোট ভাইয়ের ক্যাডেট কলেজের বেতন দিতে তার বাবা হিমশিম খেতেন। এমন সংগ্রামের সংসারেই মেয়র আনিসুল হকের বেড়ে ওঠা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

এদেশের শিক্ষিতদের পড়াশোনা শেষ করে বেকার জীবন কাটাতে হয়। পড়াশুনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তো দূরের কথা সামান্য কোনো রকমের জব খুঁজে পেতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। যাই হোক, আনিসুল হকও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করার পর বেশ কয়েক বছর বেকার ছিলেন। এরপর বিটিভিতে কাজ শুরু করেন, পাশাপাশি চাকরি খুঁজতেন।

টিভি উপস্থাপক হিসেবে ৮০ ও ৯০ এর দশকে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দেশের মানুষের কাছে আনিসুল হকের পরিচিতির শুরুটা বিটিভির কয়েকটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে। বিশেষ করে ৮০’র দশকে ‌‘বলা না বলা’ এবং ‘জানতে চাই’ নামের অনুষ্ঠান দু’টি উল্লেখযোগ্য। তবে ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ নামের একটি এক পর্বের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে উপস্থাপক হিসেবে আনিসুল হক তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ১৯৯১ সালের আলোচিত নির্বাচনের আগে আগে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া তার এই অনুষ্ঠানে প্রথম এবং শেষবারের মতো মুখোমুখি বসেন। আনিসুল হক সে সময় এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান।

২৫/২৬ বছর বয়সেই তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করার সুবাধে। কিন্তু যেভাবে চলছিল এভাবে চলা যায় না। তার জীবনের অনিশ্চয়তা দেখে একদিন তাকে তার বাবা ডেকে জানতে চাইলেন, তুমি কি করতে চাও? তখন তিনি বললেন, ব্যবসা করতে চান। তখন তার বাবা বললেন, আমি আমার পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা তোমাকে দেবো, এ টাকা দিয়ে তুমি ঠিক করো, তুমি কি করবে। তখন তিনি তার বাবাকে জানালেন, পাটের ব্যবসা করতে চান। তার বাবা তার কথা শুনে পাটের ব্যবসার জন্য তাকে ১৬ হাজার টাকা দেন।

তখন আনিসুল হক ভেবেচিন্তে হিসেব করে দেখলেন এই টাকা দিয়ে দুই ট্রাক পাট সাপ্লাই দিতে পারলে বেশ ভালো লাভ করা যাবে। ভাবনা অনুযায়ী সব হিসেব ঠিকঠাক করে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে পাট কিনতে চলে গেলেন। স্থানীয় একজন পাট কেনার সময়ে বলছিল, স্যার পাটের ট্রাক কিন্তু চুরি হয়।

আনিসুল হক এ কথা শুনে ভাবলেন, বাবার সারা জীবনের পেনশনের টাকা দিয়ে পাট কিনছেন। এ পাটের ট্রাক চুরি হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রথম ট্রাকে তাই তিনি উঠে বসলেন। ট্রাক ছাড়লো রাত ১১টায়। প্রথম ট্রাকের চালকের পাশে তিনি গিয়ে বসলেন। পেছনের ট্রাক সামনের ট্রাককে ফলো করে এগোতে থাকল। হঠাৎ রাত দুইটার দিকে মাঝপথে ট্রাক থামিয়ে চালক জানতে চাইলেন, স্যার কি প্রস্রাব করবেন? সেই মুহূর্তে আনিসুল হক কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে তাকে লাথি মেরে ট্রাকচালক বাহিরে ফেলে দেয়। সেদিন রাতে দুই ট্রাক পাট চুরি হয়ে যায়।

আনিসুল হকের জীবনের প্রথম ব্যবসার শুরুতেই ক্ষতির সম্মুখীন হলেন। বলা যায় শুরুর পূর্বেই এই ধাক্কাটা খেলেন। চুরির ঘটনার পর তার বাবার কাছে গেলে তখন তার বাবা বললেন, তুমি ভালো করে চিন্তা কর কি করবে? আমার কাছে আরও কিছু টাকা আছে, আমি তোমাকে দিব।

এরপর আনিসুল হক তার চার বন্ধু মিলে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। চার বন্ধুর মধ্যে একজন সদ্য বিয়ে করা নববধূর গহনা বিক্রি করলেন, আরেকজন একবছরের চাকরির জমানো টাকা দিলেন, অন্যজন বাবার জমি বিক্রির টাকা আনলেন আর আনিসুল হক তার বাবার কাছ থেকে পেলেন ৮৫ হাজার টাকা। চার বন্ধুর সব মিলিয়ে এক লাখ ৯৪ হাজার টাকা জোগাড় করলেন। তাদের সংগ্রামের জীবন এরপর শুরু করলেন তারা। এরপর তিন বছর ব্যবসা চালিয়েছেন একটি ১৮০ ফুটের রুমে। আর এখন তিন বন্ধু মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের কাজ দিয়েছেন।

স্বপ্ন মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়, এমন বিশ্বাস করতেন আনিসুল হক। তাই তিনি স্বপ্ন দেখতেন আর স্বপ্নের বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। সেই পরিশ্রম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকে সফল করে।

বিটিভির উপস্থাপক থেকে হয়েছেন মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান। এরপর তিনি হয়েছেন জনপ্রিয় ব্যবসায়ী নেতা। এরপর ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এছাড়া সার্ক চেম্বারের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন আনিসুল হক।

সব কিছু ছাপিয়ে এরপর রাজনীতির মাঠে চলে আসলেন আনিসুল হক। ২০১৫ সালে দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটি (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলোচনায় আসেন তিনি। ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পান তিনি।

মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘আমি সরকারি দলের প্রার্থী নই, দলীয় প্রার্থী নই। কিন্তু, তারা আমাকে সমর্থন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন রয়েছে- এটাই আমার শক্তি।’

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ফু-তে আমি আনিসুল হক নেতা হয়ে গেলাম’- এমন মন্তব্যও করেন তিনি। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় ‘চমক’ দেখান এই সাবেক উপস্থাপক। নিজের নির্বাচনী ইশতেহারে আনিসুল রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিপুল গণসমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আনিসুল হক।

মেয়র হিসাবে দায়িত্বগ্রহণের পর নগরীর সৌন্দর্য বর্ধন এবং গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃংখলা আনার ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেন আনিসুল হক। ২০১৫ সালের নভেম্বরে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে থাকা তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেন তিনি। দখলদারদের তীব্র তোপের মুখে এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই।

২০১৬ সালের নভেম্বরে বনানী ২৭ নম্বর সড়কের কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী আব্দুল মোনেম খাঁর পরিবারের অবৈধ দখলে থাকা ১০ কাঠা জমি উদ্ধারে নেতৃত্ব দেন আনিসুল হক। স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে ৫০ বছর ধরে বেদখল থাকা জমিটি উদ্ধার করে ডিএনসিসি।

এছাড়া নগরীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় দিনে-রাতে ছুটে গিয়েছেন আনিসুল হক। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন মানুষের কাছাকাছি থাকতে, তাদের কথা শুনতে। ২০১৭ সালের মে মাসে মেয়র হিসেবে দায়িত্বপালনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে মতবিনিময়ের সময় বিলবোর্ড সরানো, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন আনিসুল হক।

আনিসুল হক মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একটা মানুষের জীবনে মায়ের দোয়া এবং ছায়া অনেক বড় শক্তি। সব সময় মায়ের দোয়া নিয়েই পথ চলতেন। প্রায় শবে বরাতের রাতে মায়ের পায়ের নিচে শুয়ে আনিসুল হক মা কে বলতেন, মা তুমি আমার গায়ের উপর একটা পা রাখো আর আমাকে একটা ফুঁ দিয়ে দাও। মা তাঁর পাগল ছেলের আবদার রাখতেন। আনিসুল হকের মা আর ৮/১০ টা মায়ের মতো খুব শিক্ষিত ছিলেন না। তারপরও আনিসুল হক প্রতিটি পদক্ষেপে মায়ের দোয়া নিতেন। মা এর মতামত নিয়ে পথ চলতেন।

স্কুল লাইফে একবার ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে তাঁর ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসলো। তিনি মাকে গিয়ে বললেন, আমি পরীক্ষা দিতে পারবো না। আমার চোখ ঠিকমতো খুলতে পারছি না। মা বললো - বাবা, এই পরীক্ষা না দিলে তো তুমি এক বছর পিছিয়ে পড়বে। এরপর মা দোয়া দুরুদ পড়ে আনিসুল হকের পুরো শরীরে ফুঁ দিয়ে সাথে করে নিয়ে গেলেন পরীক্ষা দিতে। ৩ ঘণ্টার পরীক্ষা। উনি ২ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়েই বের হয়ে আসলেন। মা বাহিরেই অপেক্ষায় ছিলেন। বের হয়ে আসার পর জানতে চাইলেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছো ? উনি জানালেন, ৩৪ এর উত্তর দিয়েছি। মা জানতে চাইলেন, পাশ কততে? তিনি বললেন, ৩৩ পেলে পাশ। এরপর মা বাড়ি গিয়ে নফল নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে বিভিন্ন দোয়া দুরুদ পড়ে আনিসুল হকের সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আনিসুল হক পরীক্ষায় ৩৪ এর উত্তর দিয়ে ঠিক ৩৪ই পেয়েছেন। ওই সময়ে পরীক্ষায় ৩৪ এর উত্তর দিয়ে ৩৪ পাওয়া কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। আনিসুল হক ঠিকই বুঝেছিলেন এটা মা এর দোয়ার বরকতে হয়েছে। 

মাকে নিয়ে উনার আরও একটি গল্প শেয়ার করছি। যখন প্রধানমন্ত্রী জানালেন যে, তিনি তাঁকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের জন্য মনোনয়ন দিতে চান। তিনি তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন । বাবার কাছে গেলেন, বাবা বললেন তোমার মায়ের কবরের পাশে যাও। তোমার মা কবরে থেকে তোমাকে ফুঁ দিয়ে দিবেন। উনি তাই করেছিলেন। মা বেঁচে নেই তারপরেও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এখনো মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন।

আনিসুল হকের স্ত্রীর নাম রুবানা হক। তাদের তিন সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে নাভিদুল হক বোস্টনের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে মোহাম্মদি গ্রুপের পরিচালক ও দেশ এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে কাজ করছেন।

আনিসুল হক ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রাত লন্ডনের স্থানীয় সময় (বিকাল ৪.২৩ মিনিট) বাংলাদেশ সময় ১০.২৩ মিনিটে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি।
ভিডিওতে শুনুন

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.